শুরু হল নাটক।


শুরু হল নাটক।

প্রথম দৃশ্যেই নিমচাঁদরুপী গিরিশ চন্দ্র। যেমন দাঁড়ানোর ভঙ্গি তেমন হাঁটাচলা, তাকানো, এইরকম সংলাপ ও উচ্চারণ। মেঘমন্দ্র কণ্ঠস্বর। মঞ্চে নৃপতি। গলায় একটি করে মদ ঢালছেন আর উকিল লকুলস্বরকে বলছেন, Rich the treasure/ Sweet the pleasure/Sweet is pleasure after pain….ডারউইনের কবিতার লাইন…Alexander’s feast..নিজের রচিত চরিত্রটি মঞ্চে জীবন্ত দেখে নাট্যকার দীনবন্ধু নড়েচড়ে বসলেন। গিরিশের অভিনয়ে তার নিমচাঁদের প্রাণ প্রতিষ্টা পেয়েছে।

আমি অনেককেই বলতে শুনেছি শনি আর বুধ যদি একসাথে অবস্থান করে তাহলে নাকি মানুষ অন্তর্মুখী হয়ে ওঠেন, বেশি কথা বলতে পছন্দ করেন না আর সকলের সামনে বেশি কথা বলতে পারে না। কিন্তু গিরিশ বাবুর জীবন চরিতে সেটা একদম ভূল প্রনানিত হচ্ছে, আসলে শনি আর বুধের কম্বিনেশনে মানুষ সত্যি কথা বলতে পছন্দ করেন, মিথ্যে বলতে পারেন না।

সেই থিয়েটার এর নাম স্টার কেন? কেন বিনোদিনীর নামে বি-থিয়েটার হল না, কেন? হোয়াই?

আমার জন্য অর্ধ্যেন্দু আমার সঙ্গী সাথীদের প্ররোচনায় আমার এই সংকীর্ণতা। তার মধ্যে তুমিও আছ। আমার এত বড় একটা শরীর, কিন্তু হৃদয়টা মুরগীর।

আর ভেবে কি হবে?

ভাবব না মানে? কালের দর্পণে আমাদের যখন দেখা হবে, সে মুখের ছবি কেমন দেখাবে? তোমার অমৃতকেও বোলো।

কোন অমৃত?

মিত্তির, আমার বিনোদের টোপে গুমূর্খকে খেলিয়ে তুলেছিলাম, ঠিক কি না?

অবশ্যই। মহাহুজ্জত। বিনোদ সে যাত্রায় প্রাণে বেঁচেছে। তার আগের বাবু তো তরোয়াল নিয়ে কাটতে এসেছিল।

দুটো কোপ তো ঝেড়েছিলো। বিনোদ সাহসী।
নারী মাত্রই সাহসী।

আঃ মন্তব্য করোনা। আমাকে নারী চেনাতে এসো না। আমার লগ্নে শুক্র তুঙ, মঙ্গল দ্বিতীয়ে, তৃতীয় চন্দ্র তুঙ্গে।

গিরিশ বাবুর জন্ম বিভিন্ন ২৭/০২/১৮৪৪ সালের সকাল ৭ তার পরে, এই দিন নিয়ে অনেক জায়গায় দ্বিমত আছে, অনেকেই ওনার জন্মদিন ২৭/০২/১৮৪৪ সাল পালন করেন।

চন্দ্রের দশায় জন্ম আর মঙ্গলের দশায় শৈশব, পারে প্রতিবেশী গিরিশ নামেই কেঁপে উঠতো। শৈশবের ১১ বছর কাটিয়ে এলো ১২সে অবস্থিত বৃহস্পতির দশা। ১২সে গুরুর অবস্থান তারপর গুরুর দশা।

পাড়ায় সাধু সন্যাসী ঢুকলেই মেরে তাড়াত। পথের ধারে শিব ঠাকুর, পাথরের নুড়ি, প্রায় সবটাই গিরিশের পেচ্ছাপে স্নান করেছে। সেই ছেলেটাই কি হয়ে গেল, মানিক রে একেই বলে বরাত। কার যে কখন কি হয়, প্রতিভার কাছে ভোগবানও জব্দ।

একাদশে অবস্থান শনির দশা।
বুধের সাথে সহাবস্থান মকরে।

শরীর পরে থাকে কিন্তু তার আত্মা বার বার ছুটে চলে যায় শ্রী রামকৃষ্ণ এর কাছে, ওনাকে সবাই ঠাকুর বলেই ডাকেন। গিরিশ বাবুর নিজের সাথে বোঝা পরে চলছে প্রতিনিয়তই।

ঠাকুর সহসা গিরিশকে প্রশ্ন করলেন, তুমি কে?

গিরিশ একটু থতমত খেয়ে, লোকমুখে নিত্য তার পরিচয় শোনেন, সেটাই বলবেন, আমি পাপী।

ঠাকুর বললেন, কিছুই জানো না তুমি। তুমি আমার ভিতরেই আছ। আমারই এক সত্তা।

গিরিশ বিস্ফোরিত চোখে শুনছেন। এ আবার কি কথা, তার মনে হল, প্রকৃত পরিচয় জানেন না বকেই এত স্নেহ, জানলে এই ভালোবাসা থাকবে কি? গিরিশ চন্দ্র লুকোচুরি পছন্দ করেন না। তার মুখে এক, কাজে এক এমন তো নয়।

এই সরল, সুন্দর ভগবান তুল্য মানুষটিকে ঠকানো উচিত? সে তো সকল পাপের সেরা পাপ, মহা পাপ।

গিরিশ বললেন, অনি বেশ্যা সংসর্গ করি, কখনো কখনো দিবা রাত্রি মদ খাই।

তুই আবার চৈতন্য লীলার, প্রহ্লাদ চরিত্র লিখিস। তোর দর্শন হয়নি?

চমকে উঠলেন গিরিশ চন্দ্র।
ঠাকুর হাসছেন, তুই মায়ের কৃপায় দুবার প্রাণে বেঁচেছিস, শত্রুরা তোকে স্পর্শ করতে পারেনি। প্রবল ইচ্ছে শক্তিতে তুই মোরণাপন্নকে ফিরিয়ে আনিস, যে কোনো অসুখ ভালো করতে পারিস, তুই খামের ভিতরের চিঠি খাম না খুলেই পড়তে পারিস।
গিরিশ চন্দ্র হতবাক।

ঠাকুর এদেশের সুরে বললেন, দিয়ে দে, তোর সমস্ত সিদ্ধাই আমাকে দিয়ে দে। ওঠে নীচ অহংকার বেড়ে যায়। মাকে পাওয়া যায়না। মা আমাকে দেখিয়ে দিয়েছেন তোর স্বরূপ।

কালীমন্দিরে সমাধিস্থ একদিন। দেখেছি, এক উলঙ্গ, উদগ্রীব বালক মূর্তি, মাথায় ঝুটি বাধা, বাঁ বগলে সূরাপাত্র, দান হাতে সুধাভান্ড। মন্দিরে প্রবেশ করেছে। আমি জিজ্ঞাসা করলুম, তুমি কে?
বালক বললে, আমি ভৈরব, তোমার কাজ করতে এসেছি। বলেই ওই বালক আমার দেহে প্রবেশ করল। তুমি সেই। টুনি আমার ভৈরব। অন্যের যেটা মহাপাপ, তোমার সেটা কিছুই নয়। তাকে স্পর্শ করবে না। তুই আমার বীরভক্ত, আমার শুরভক্ত। কত বড় কাজ তুই করেছিস, থিয়েটারের মাধ্যমে লোকশিক্ষা, উচ্চ ভাবের প্রচার, ভক্তির প্রবাহ।

প্রনাম করে গিরিশ চন্দ্র উঠে দাঁড়ালেন।
ঠাকুর উঠলেন।
গিরিশ চন্দ্র সঙ্গে উত্তরের বারান্দা পর্যন্ত এলেন।
একান্তে পেয়ে গিরিশ বললেন, “আমি আয়নার দর্শন করেছি। আপনার কৃপালাভ করেছি। আবার কি আমায় করতে হয় তাই করতে হবে?

ঠাকুর গিরিশের পিঠে হাত রেখে বললেন, “তা করো না।”

কোনো দোষ হবে না।

কিসের দোষ, হলেও তোমাকে স্পর্শ করবে না।

সম্রাট বোস
7890023700