জীবনানন্দ দাশ


কবি নিয়ে এর আগেও আমি লিখেছি, তাই কোন যোগে কবি হওয়া যায় আজ নতুন করে কিছু বলার নেই। ৩যে উচ্চস্ত চন্দ্র লেখনীর ইচ্ছে বৃদ্ধি করেছে তারসাথে শনি আর চন্দ্র যোগ বুকের চাপা কষ্ট অনুভব করতে সাহায্য করেছিল। বুধ একাদশে অবস্থান করে লেখনীর ইচ্ছেটা স্বতঃস্ফূর্ত বাড়ালেও বৃহস্পতি ৮মস্ত হয়ে গভীরতায় পৌঁছে দিয়েছিল।

জীবনজুড়ে যার ব্যর্থতার গ্লানি মরনোত্তর খ্যাতিতে তাঁর কী এসে যায়? ১২ শে রবি, ব্যর্থতার যন্ত্রনা।

●●অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই—প্রীতি নেই—করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক ব’লে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়●●

অধিকাংশ কবির কবিতা পড়লেই হয়ে যায়, কিন্তু এই কবির কবিতা ভাবতে হয়। ভাবতে ভাবতেও বোঝা যায় না। অনেক কবিতা অনেকবার পড়ার পরেও দুর্বোধ্য থেকে যায়, সেই দুর্বোধ্যতা এবং রহস্যময়তার কারণেই কী আরো বেশী আকর্ষণ ভর করে তাঁর কবিতায়। পরতে পরতে জীবনের অবিরাম ব্যর্থতা কবিতার ছত্রে ছত্রে সৃষ্টি করেছে বেদনা ও রহস্যের এক দুর্মর জটাজাল। সেই জাল ছাড়াতে মৃত্যুর ছয় দশক পরেও অব্যাহত আছে গবেষণা।

রাহুর দশায়:
গল্প উপন্যাস লিখেছেন ১৯৩৩ সালে যখন তিনি কর্মহীন ছিলেন। ‘কারুবাসনা’, ‘কল্যাণী’ ইত্যাদি সেই সময়কার উপন্যাস। ১৯৩০ সালে লাবণ্য দাশকে বিয়ে করার পর তিনি বেকার অবস্থায় বরিশালেই অবস্থান করছেন। জীবনানন্দ ১৯৩০-৩৫ পর্যন্ত কোন রকম নিয়মিত জীবিকার সাথে যুক্ত ছিলেন না। ১৯৩৫ সালে বরিশাল বিএম কলেজে যোগ দেন এবং ১৯৪৬ সালে কোলকাতা যাবার আগ পর্যন্ত ওই কলেজেই চাকরী করেন। কোলকাতা ফেরার পর আবারো কর্মহীন সময়।

১০মে অবস্থানকারী নীচস্ত রাহু কর্ম জীবনে কোনোদিন সেই ভাবে তুলে ধরতে পারেনি কিন্তু মরণের১০০ বছর পরেও সেই রাহুর দশায় ফেলে আসা কাজগুলো আজ তাকে ওমর করে রেখেছে। তার পরে এলো ৮মে বৃহস্পতির দশা, তখনও তিনি কর্মহীন জীবন যাপন করেন।

উপন্যাসগুলোও সেই কর্মহীন সময়েই লেখা। গদ্য লিখে পয়সা আয় করার কথা কে যেন বলেছিলেন তাঁকে। তাই অভাবের সময়েই উপন্যাসগুলো লিখেছেন। ‘মাল্যবান’, ‘সুতীর্থ’ ইত্যাদি উপন্যাস ১৯৪৮ সালে লেখা। সুতরাং এই সিদ্ধান্তে আসা ভুল হবে না যে জীবনানন্দ হয়তো আর্থিক দুরাবস্থায় গদ্য লিখে আয় করতে চেয়েছিলেন কিন্তু শেষমেষ টাকার কাছে হার মানেননি।

একটা মানুষের সংসার জীবন কতটা দুর্বিসহ হলে তার বিবরণ পড়ে এই ১১৯ বছর পরেও মনটা তিক্ততায় বিষাদে বিরক্তিতে থম ধরে থাকে সেটা বলাই বাহুল্য। সংসার জীবন ৪থে মিঠুন রাশিতে মঙ্গল এবং নীচস্ত কেতুর অবস্থানে সংসার জীবনে অশান্তির সৃষ্টি করেছিল তারসাথে ৪পতি বুধ রাহু আর শনি দ্বারা পীড়িত।যে মানুষের নামের সাথে আনন্দের এত ঘনিষ্ট যোগাযোগ সেই মানুষটি বাস্তব জীবনে আনন্দ থেকে কতো দূরে কাটিয়েছে! বুঝি না যে যুগে মানুষ মেট্রিক পাশ করেও স্বচ্ছল সুখী জীবন যাপনের মতো আয় উন্নতি করতে পারতো, সেই যুগে এমএ পাশ করেও একটা মানুষ চাকরি পেতে হিমশিম খায়, চাকরী পেলেও টিকিয়ে রাখতে গলদঘর্ম হয়।

এই অযোগ্যতার দায় সম্পূর্ণভাবে তার পরিবার বা সমাজের নয়, এই দায়ের অনেকটাই জীবনানন্দের নিজের জন্ম কুন্ডলীতে বলা যেতে পারে, ৮মস্থ লগ্নপতি বৃহস্পতি নীচস্ত রাহুর নক্ষত্রে অবস্থান তারসাথে লগ্ন ১২পতির নক্ষত্রে অবস্থান করে লগ্ন ভাবকে দুর্বল করেছে। কোন কোন মানুষ হয়তো প্রচলিত ধারার একটা জীবনে খাপ খেয়ে চলতে পারে না। যোগ্যতা থেকেও ছিটকে যায় লাইনের বাইরে। জীবনানন্দ সেরকম ছিটকে যাওয়া একজন মানুষ। জীবন যাকে বঞ্চিত করেছে, নিজেকেও যিনি বঞ্চিত করেছেন।

সম্রাট বোস।
7890023700